স্বদেশ ডেস্ক:
‘কক্সবাজারে আমরা অনেক বেশি গাদাগাদি করে থাকতাম, থাকতাম ঝুপড়ি ঘরে। সেখানে প্রতিদিনই ডাকাতের ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে হতো। বলার মতো তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। এখানে এসে দেখি সবকিছুই উন্নত। খুবই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে শরণার্থীরা এমন সুযোগ পেয়েছে কিনা আমার জানা নেই।’- ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো আনোয়ারা বেগমের কণ্ঠ। এ প্রান্ত থেকেও টের পাওয়া গেল তার মনের স্বস্তি। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশে আশ্রিত শরণার্থী হিসেবে গর্ববোধ হচ্ছে। আমাদের জন্য এমন উন্নত সুযোগ তৈরি করায় বাংলাদেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
রোহিঙ্গাদের যে দলটি কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত হয়েছে, আনোয়ারা সে দলেরই একজন। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্প থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। গতকাল থেকে নিজেদের ঘরে রান্নাবান্না শুরু করেছে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো।
মিয়ানমারে নিজের স্বামীকে হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আনোয়ারা বেগম বলেন, তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে ভাসানচরে এখন খুব আরামে আছি। কক্সবাজারের ঘিঞ্জি ও অপরিচ্ছন্ন ক্যাম্পের পরিবর্তে ভাসানচরের উন্নত পরিবেশে বসবাসের সুযোগ পেয়ে আমরা খুবই খুশি। আজ (গতকাল) থেকে আমাদের নিজ ঘরে রান্নাবান্না শুরু করেছি। আশা করি, আমরা এখানে সারা বছর সুখে-শান্তিতে থাকতে পারব।
ভাসানচরের রোহিঙ্গা
নেতা (মাঝি) মো. কাসেম আমাদের সময়কে বলেন, উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে গাদাগাদি করে বসবাস ছেড়ে ভাসানচরে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক পরিবেশে ঠাঁই পেয়েছি। আমাদের অনেকেই ভাবতে পারেনি, এখানে আমাদের জন্য এমন চমৎকার পরিবেশ করা হয়েছে। এখানে এসে যা দেখছি, তা কল্পনাও করতে পারিনি।
তিনি জানান, বাস্তবে ভাসানচরে এসে সবকিছু দেখে রোহিঙ্গারা খুবই আনন্দিত। কাসেম বলেন, এখানে আসা রোহিঙ্গারা তাদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কথা মোবাইলে আত্মীয়স্বজনের জানাচ্ছেন। কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা এখন তাদের কথা শুনে ভাসানচরে আসতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আমি মনে করি, উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পে আশ্রিত অধিকাংশ রোহিঙ্গা নিজের ইচ্ছাতেই ভাসানচরে আসতে আগ্রহী হবেন।
ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের পরিবারগুলোয় গত শনিবার পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গতকাল থেকে রোহিঙ্গারা নিজেদের ঘরে রান্নাবান্না শুরু করেছে। ভাসানচরে কাজ করা দেশি-বিদেশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধসহ জীবনধারণের যাবতীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছে কক্সবাজারের স্থানীয়রা। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের চাপ অনেকটা কমবে বলে মনে করছে তারা।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে পৌঁছেছে মিয়ানমারে নিজ ভিটা ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি দল। ১ হাজার ৬৪২ সদস্যের ওই দলে পুরুষ ৩৬৮, নারী ৪৬৪ জন এবং ৮১০টি শিশু রয়েছে। সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রকল্পের আওতায় নতুন নির্মাণ করা আবাসস্থল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত মে মাস থেকে এখানে বসবাস করছে আরও ৩০৬ রোহিঙ্গা। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ ৩০৬ জন রোহিঙ্গা দুই দফায় বাংলাদেশে ফিরে আসে। নারী-শিশুসহ তাদেরও ইতিপূর্বে ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সে দেশের প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। একই কারণে এরও আগে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন শিবিরে ১২ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে তাদের অন্যত্র স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার এবং এরই ধারাবাহিকতায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে আবাসনব্যবস্থা নির্মাণ করে সরকার।